গণমাধ্যমের দায়দায়িত্ব বনাম ক্ষমতা
কাজেই সাংবাদিকের লেখার ক্ষমতা কেবল জনগণের কল্যাণেই ব্যবহার করতে হবে, সাংবাদিকের নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে নয়। ‘ক্ষমতার দাপটে’ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে না উঠে গণমাধ্যম ও এর কর্মীদের ভাবতে হবে, তিনি জনগণের সেবায় নিয়োজিত। একজন সাংবাদিক এ কথা মনে-প্রাণে ধারণ করলেই কেবল দেশ ও দশের কল্যাণ সম্ভব।
গণমাধ্যমকে বলা হয় একটি রাষ্ট্রের দর্পণ বা আয়না। সমাজে বা রাষ্ট্রে যা ঘটছে, সে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি অবিকৃতভাবে গণমানুষের সামনে তুলে ধরবে গণমাধ্যম ঠিক যেভাবে একজন ব্যক্তির অবিকল প্রতিকৃতি একটি আয়না তুলে ধরে। আর এ কাজটি কীভাবে হবে, তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি জনপরিসরেও গণমাধ্যমের দায়িত্ব বা কাজ নিয়ে যুগে যুগে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে বিশ্বের নানা দেশে গণমাধ্যম যেগুলোকে তাদের দায়িত্বের অংশ অর্থাৎ অবশ্য-কর্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, তার মধ্যে রয়েছে : জনগণকে তথ্য জানানো, সচেতন করা, প্রভাবিত করা, বিনোদন দেওয়া, সমাজে ও রাষ্ট্রে নজরদারি করা এবং জ্ঞানের প্রবাহ প্রজন্মান্তরে চলমান রাখা।
বিষয়গুলোকে একেবারে সংক্ষেপে যদি বোঝানোর চেষ্টা করা যায় : গণমাধ্যমের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো দেশ-বিদেশে ঘটমান বা চলমান নানা বিষয়ের জরুরি তথ্য জনগণকে জানানো। কিছু তথ্য থাকে যা জানানোর মধ্য দিয়ে জনগণকে নানা বিষয়ে সচেতন করা হয়। আর সচেতন করে তোলার মাধ্যমে প্রয়োজনে কোনো বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে জনগণকে প্রভাবিত করা হয়। এর বাইরে মানুষের কর্মব্যস্ত কঠিন জীবনের ক্লান্তি ও হতাশা দূর করতে পত্রিকার বিনোদন পাতা কিংবা অন্য মাধ্যমের নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি ব্যাপক ভূমিকা রাখে। গণমাধ্যমের আরেকটি বড় কাজ হলো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নজর রাখা; কোথাও কোনো অন্যায়-অনিয়ম বা জনগণের দুর্ভোগের ঘটনা ঘটলে কিংবা এমনটি ঘটবার আশঙ্কা তৈরি হলে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তা প্রতিহত বা সমাধানের চেষ্টায় অংশ নেওয়া গণমাধ্যমের দায়িত্ব। সর্বোপরি, এক প্রজন্মের শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন-ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা তথা একসময়ের সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ নানা উপলক্ষে বারবার তুলে ধরার মাধ্যমে তা অন্য প্রজন্মের নজরে আসে এবং তাদের কাছে সহজলভ্য হয়।
মোটামুটি এই হলো গণমাধ্যমের অনিবার্য দায়িত্ব। আর গণমাধ্যমের ‘দায়’ যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেখা যায়, পশ্চিমের তাত্ত্বিকরা এখন বলছেন, কেবল তথ্য (সংবাদ) পাঠকের সামনে তুলে ধরাই যথেষ্ট নয়, সেই তথ্যকে তাদের জন্যে বিশ্লেষণও করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়াও গণমাধ্যমের দায় বলে ভাবেন অনেক তাত্ত্বিক। পাশাপাশি, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাংবাদিকতা করতে হবে যার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক পরিবর্তনকে উৎসাহিত করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের প্রয়োজনে গণমাধ্যমকেই জনমত গড়ে তোলার দায়টি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে।
কিন্তু এখন যদি প্রশ্ন তোলা হয়, দেশের গণমাধ্যম দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, আর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়বোধই বা কতটুকু সে প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর মিলবে না। অনেক গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতি ঝোঁক এত প্রবলভাবে দৃশ্যমান যে দায়িত্ব পালন নয়, বরং ‘ক্ষমতাচর্চাই’ তাদের ধ্যান-জ্ঞান বলে মনে হয়।
কিন্তু সাংবাদিকতা কি আসলে কেবল ক্ষমতা?
সাংবাদিকের অসীম ক্ষমতা রয়েছে- কথাটি সত্য। তবে ভুলে গেলে চলবে না, এ ক্ষমতা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়। একজন সাংবাদিক নিজেকে কেবল তখনই ক্ষমতার অধিকারী ভাবতে পারেন, যখন তিনি পরার্থে কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে ‘স্পাইডারম্যান’ চরিত্রটির কথা মনে করা যেতে পারে; এ চরিত্রের মূল দর্শন হলো : ‘‘with great power, comes great responsibility; ক্ষমতা থাকলে সঙ্গে দায়িত্ববোধও থাকা দরকার। যার যত ক্ষমতা, সমাজের প্রতি তার দায় তত বেশি।
ইংরেজ ঐতিহাসিক, রাজনীতিক ও লেখক লর্ড অ্যাকটন (John Emerich Edward Dalberg-Acton) ইংল্যান্ডের প্রথম ব্যারন অ্যাকটন) একবার এক ধর্মযাজকের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ক্ষমতার চরিত্রই হলো দুর্নীতিপ্রবণ; ক্ষমতা যত বেশি, দুর্নীতির প্রবণতাও তত বেশি (Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely) গণমাধ্যমের ব্যাপ্তি ও জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সীমাহীন বললে অত্যুক্তি হবে না। তাই আইন, বিচার ও প্রশাসন এই তিনের বাইরে সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ (fourth estate) বা চতুর্থ ক্ষমতা (ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান অর্থে) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে সাংবাদিকরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এটাই কাম্য। বিশ্বজুড়ে বলা হচ্ছে, গণমাধ্যমই পারে একটি দেশের গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে। এ জন্য গণমাধ্যমের কেবল স্বাধীনতাই নয়, প্রয়োজন রয়েছে দায়িত্বশীলতারও।
কাজেই সাংবাদিকের লেখার ক্ষমতা কেবল জনগণের কল্যাণেই ব্যবহার করতে হবে, সাংবাদিকের নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে নয়। ‘ক্ষমতার দাপটে’ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে না উঠে গণমাধ্যম ও এর কর্মীদের ভাবতে হবে, তিনি জনগণের সেবায় নিয়োজিত। একজন সাংবাদিক এ কথা মনে-প্রাণে ধারণ করলেই কেবল দেশ ও দশের কল্যাণ সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক; জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ; স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক দেশ রূপান্তর-এ, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।